বিএনপির তীব্র বিরোধিতায় রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনকে অপসারণে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র নেতাদের প্রচেষ্টা হোঁচট খাচ্ছে। এটিকে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার একটি চক্রান্ত হিসেবেও দেখছে বিএনপি।
জামায়াত ও বিভিন্ন ইসলামী দলগুলো রাষ্ট্রপতির অপসারণের পক্ষে তাদের সমর্থন দিলেও বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলছেন, তাদের মিত্রদের বেশিরভাগই এই প্রচেষ্টার বিরোধিতা করার পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। এটি সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকট শুরুর ঝুঁকি তৈরি করেছে বলেও জানান বিএনপি নেতারা।
এই বিভাজন এ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছানোর প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলছে। কারণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এই জাতীয় ঐকমত্যের ওপর গুরুত্ব দেয়।
বিএনপি নেতারা বলেছেন, তারা রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের অবস্থান থেকে জামায়াতকে সরাতে রাজি করানোর চেষ্টা করছেন এবং সতর্ক করেছেন, শেখ হাসিনার সরকারকে যারা অপসারণ করেছেন, তাদের মধ্যে যেকোনো বিভাজন পদচ্যুত আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ তৈরি করতে পারে।
শনিবার ছাত্র নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর সোমবার এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম বিএনপির স্থায়ী কমিটি। তারা তাদের অবস্থানে অটল থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টাকে একটি গভীর সংকট তৈরির চক্রান্ত হিসেবে দেখছে; যা গণতন্ত্রে উত্তরণের পথকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য ইউএনবিকে বলেন, 'আমাদের বৈঠকে সাতজন ছাত্রনেতা এ বিষয়ে আলোচনা করতে দলীয় নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। আমরা রাষ্ট্রপতির অপসারণের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করেছি। সব সদস্য আমাদের পূর্ববর্তী অবস্থানে অনড় থাকতে সম্মত হন; আমরা এক ইঞ্চিও নড়ব না।’
তিনি বলেন, আমরা মনে করি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করা এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণকে বিপন্ন করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবি করা হয়েছে। এই পদক্ষেপের পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে।
বিএনপি নেতা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করে সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করলে অপ্রয়োজনীয় সংস্কার ও নানা ইস্যুতে পরিস্থিতি জটিল হবে। শেষ পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত হবে।
তিনি উল্লেখ করেন, এ অবস্থায় বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অধিকাংশ দল ও জোটের সঙ্গে কথা বলে রাষ্ট্রপতি অপসারণের পদক্ষেপকে সমর্থন না করার জন্য বুঝিয়েছেন তারা।
আরও পড়ুন: ছাত্র-জনতার অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষা করবে যুবদল: মঈন খান
এছাড়া গণতান্ত্রিক ও নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য সরকারকে চাপ দিতে আগামী মাসে বিভিন্ন বিভাগ ও জেলায় সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান বিএনপির এই নীতিনির্ধারক।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, বিএনপি মনে করে, নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করাই সরকারের প্রধান এজেন্ডা হওয়া উচিত।
‘কিন্তু হঠাৎ করে রাষ্ট্রপতির প্রসঙ্গ উঠল কেন?’ প্রশ্ন তোলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, সংবিধান লঙ্ঘন করে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যৌক্তিক হবে না, কারণ এটি দেশে গুরুতর সাংবিধানিক বা রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
ইউএনবির সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং বিএনপির জোটসঙ্গী গণতান্ত্রিক মঞ্চের সমন্বয়ক সাইফুল হক বলেন, রাষ্ট্রপতির অপসারণের জন্য সমর্থন চেয়ে ছাত্র নেতারা তাদের কাছে এসেছিলেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের বলেছি, জাতীয় ঐকমত্যের মাধ্যমে এটা করতে হবে। রাজনৈতিক বা সাংবিধানিক সংকট তৈরি করতে পারে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য ক্ষুণ্ন করতে পারে এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না বলে আমরা তাদের জানিয়েছি।’
আরও পড়ুন: সাংবিধানিক বিষয়ে তাড়াহুড়ো করা উচিৎ নয়: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তারেক
সাইফুল বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত নির্বাচনি প্রক্রিয়া সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করা এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদক্ষেপ নেওয়া। ‘আমরা মনে করি, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা হলে পুরো প্রক্রিয়া জটিল হয়ে উঠবে, যা শেষ পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনকে বিলম্বিত করবে।’
‘তাই আমরা মনে করি, দেশের পরিস্থিতি এখনও অস্থিতিশীল বিধায় রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের বিষয়টি সরকারের গুরুত্ব দেওয়া উচিত হবে না।’
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতাচ্যুত করলে নানা সংকট দেখা দিতে পারে বলে তাদের দলও বিশ্বাস করে। ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বর্তমানে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না, তাই এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে নই আমরা।’
১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, রাষ্ট্রপতির অপসারণের বিষয়ে তারা ছাত্রনেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। ‘আমরা তাদের জানিয়েছি, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা হলে তা জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করবে এবং সাংবিধানিক ও অন্যান্য সংকট সৃষ্টি করবে।’
তিনি বলেন, এই পদক্ষেপের ফলে জাতীয় নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে বলেও তারা শিক্ষার্থীদের জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, তারা শিক্ষার্থীদের এটাও জানিয়ে দিয়েছেন, এখন রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে জাতীয় নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
বিএনপির আরেক জোট জাতীয়তাবাদী সমন্বয় জোটের সমন্বয়ক ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, তারা চান না রাষ্ট্রপতিকে জোর করে বা অসাংবিধানিক উপায়ে অপসারণ করা হোক। ‘রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জাতীয় ঐকমত্য থাকলেই তা করা উচিত। তবে আমরা এমন কোনো সম্ভাবনা দেখছি না, কারণ বেশিরভাগ দলই এই পদক্ষেপের বিপক্ষে।’
এর আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত রাষ্ট্রপতির অপসারণের মতো কোনো দুরভিসন্ধিমূলক পদক্ষেপ এড়িয়ে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করা।